পশুর যত্ন নেওয়া ও তাদের সাথে সদাচরণ করার ব্যাপারে অনেকেই ঔদাসীন্য প্রদর্শন করে থাকে। উপরন্তু অনেক মুসলমান জানেই না যে, ইসলাম পশুর অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারেও জোর প্রদান করেছে। ইসলাম আসলে পশুর উত্তম লালন-পালন ও তাদের প্রতি যত্নবান হওয়ার প্রতি বিশেষ তাকিদ দিয়েছে।
পবিত্র কুরআনে পাঁচটি সূরা রয়েছে যেগুলোর নামকরণ করা হয়েছে পশুর নাম অনুসারে। এছাড়াও কুরআনের বহু জায়গায় পশু-পাখির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আনআমে বলা হয়েছে- আর যমীনে বিচরণকারী প্রতিটি প্রাণী এবং দু’ডানা দিয়ে উড়ে এমন প্রতিটি পাখি, তোমাদের মত এক একটি উম্মত। আমি কিতাবে কোন ত্রুটি করিনি। অতঃপর তাদেরকে তাদের রবের কাছে সমবেত করা হবে। সূরা আনআম: ৩৮।
আল্লাহ তায়ালা সবচেয়ে ক্ষুদ্র প্রাণী যেমন পাখি, মৌমাছি এবং পিঁপড়াকে সৃষ্টি করেছেন ও তাদেরকে তাদের স্ব স্ব সম্প্রদায়ভুক্ত করেছেন। যাতে করে তারা দলবদ্ধভাবে কাজ করতে পারে ও সুন্দর জীবনধারণ নিশ্চিত করতে পারে। পৃথিবীতে যত প্রাণী রয়েছে সবাই আল্লাহ তায়ালার প্রশংসায় মগ্ন থাকে। আল্লাহ বলেন- সাত আসমান ও যমীন এবং এগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে সব কিছু তাঁর তাসবীহ পাঠ করে এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর প্রসংশায় তাসবীহ পাঠ করে না; কিন্তু তাদের তাসবীহ তোমরা বুঝ না। সূরা বনী ইসরাঈল: ৪৪।
ইসলাম সবসময় পশুর জীবনের নিশ্চয়তা দিয়েছে। নূহ আ. এর মহাপ্লাবনের সময় যখন গোটা পৃথিবী পানিতে তলিয়ে গিয়েছিলো, তখন আল্লাহ তায়ালা বিশ্বাসী নরনারীর সাথে পশুপাখিদের জীবনও রক্ষা করেছিলেন। এ ব্যাপারে কুরআন বলছে- আর তুমি আমার চোখের সামনে ও আমার ওহী অনুসারে নৌকা তৈরী কর। আর যারা যুলম করেছে, তাদের ব্যাপারে তুমি আমার কাছে কোন আবেদন করো না। নিশ্চয় তাদেরকে ডুবানো হবে’। সূরা হুদ: ৩৭।

একই সূরার অন্য আয়াতে বলা হয়েছে- অবশেষে যখন আমার নির্দেশ এসে পৌঁছল এবং ভূ-পৃষ্ঠ (চুলা) হতে পানি উথলিয়ে উঠতে লাগল, তখন আমি বললাম, ‘প্রত্যেক যুগল (প্রাণীর) জোড়া জোড়া তাতে (নৌকাতে) উঠিয়ে নাও এবং নিজ পরিবারবর্গকেও; তবে তাকে নয় যার সম্বন্ধে পূর্ব-সিদ্ধান্ত হয়ে আছে। আর যে বিশ্বাস করেছে তাকেও উঠিয়ে নাও। সূরা হুদ: ৪০।
পবিত্র কুরআনে সামুদ জাতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। নবী সালেহ আ. এই জাতির হেদায়েতের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি সারা জীবন তাদের হেদায়েতের পথে আনার চেষ্টা করেছেন। এতে অল্প কিছু সঙ্গী ছাড়া গোটা জাতি তার অবাধ্যই থেকে যায়। একপর্যায়ে তারা দাবি করে, আপনি যদি সত্যি নবী হয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের ‘কাতেবা’ নামের পাথরময় পাহাড়ের ভেতর থেকে একটি ১০ মাসের গর্ভবতী, সবল ও স্বাস্থ্যবতী মাদি উট বের করে দেখান।
এটি দেখাতে পারলে আমরা আপনার ওপর ইমান আনব। সালেহ আ. আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। আল্লাহর কুদরতে পাহাড় থেকে একটি অদ্ভুত রকমের মাদি উট বের হয়। তা দেখে কিছু লোক ইমান আনে। কিন্তু তাদের সর্দাররা ইমান আনেনি, বরং তারা সে মাদি উটকে হত্যা করে ফেলে। এতে সালেহ আ. তার জাতির ওপর আল্লাহর আজাব নেমে আসার ঘোষণা দেন। তিনি তাদের সতর্ক করে দেন যে তিন দিন পরই আল্লাহর আজাব তোমাদের ধ্বংস করে দেবে। নির্ধারিত সময়ে আসমানি আজাব এসে অবিশ্বাসীদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- অতঃপর তারা সে উষ্ট্রীকে হত্যা করে এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করে এবং বলে, ‘হে সালিহ! তুমি আমাদেরকে যার ভয় দেখাচ্ছে, তা নিয়ে এস, যদি তুমি রাসূলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাক। অতঃপর ভূমিকম্প তাদেরকে পাকড়াও করল, ফলে তারা নিজ নিজ ঘরে উপুড় হয়ে পড়ে (মরে) রইল। সূরা কাহফ: ৭৭-৭৮। এখান থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা একটি গোটা জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র একটি পশুকে হত্যা করার জন্য।
ইসলাম শুধুমাত্র আনন্দের জন্য পশু শিকার করাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- ‘যে ব্যক্তি চড়ুই বা তার চাইতে ছোট কোনো প্রাণীকে অযথা হত্যা করে, তাকে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। নাসাঈ: ৪৩৪৯।
ভক্ষণ করার জন্য পশু জবেহের ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা হলো, জবেহের ছুরিটা অবশ্যই ভালো করে ধার করে নিতে হবে যাতে করে পশুর যন্ত্রণা কম হয়।
একবার নবীজি সা. দেখলেন, কিছু লোক তাঁবু গেড়ে একটি পিঁপড়ার ঢিবির কাছে আগুন জ্বালিয়েছে। এটা দেখে তিনি তৎক্ষণাৎ সেই আগুন নিভিয়ে ফেলতে বলেন। আরেকবার তিনি সা. দেখলেন, কেউ একজন দুটি ছোট পাখি ধরে এনেছে, আর তাদের মা ডাকতে ডাকতে তাদের সাথে উড়ে আসছে। এটা দেখে নবীজি সা. ওই ব্যক্তিকে পাখি দুটি ছেড়ে দিতে আদেশ দেন। বুখারি।
একবার নবী সা. এক ব্যক্তির কথা বর্ণনা করলেন যে একটি কুকুরের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য পানি আনতে কুয়ার মধ্যে নেমেছিলো। আর শুধুমাত্র একটি কুকুরকে পানি পান করানোর জন্য ওই ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দেন। নবীজি সা. বলেন, প্রতিটি প্রাণীর সাথে সদয় আচরণ করা পুণ্যের কাজ। বুখারি। তিনি সা. পশুর মুখে আঘাত করতে ও তাদের গায়ে সীল লাগাতে নিষেধ করেছেন। হাদিসে পশুকে কষ্ট দিয়ে সবধরনের খেলাধুলা নিষেধ করা হয়েছে। আবু দাঊদ।
রাসুলুল্লাহ সা. তাঁর সাহাবিদেরকে সফরের সময় ব্যবহৃত পশুদেরকে রাস্তায় থাকা ঘাসপাতা খাওয়া থেকে বাঁধা দিতে নিষেধ করেছেন। তিনি সা. বলেন, এতে করে দীর্ঘ সফরে তাদের ক্ষুধা মিটবে ও কষ্ট লাঘব হবে। মুসলিম। নবীজি সা. কোনো পশুর ক্ষতি সাধন করতে নিষেধ করেছেন।
হজের সময় যখন কোনো হাজী ইহরাম বেধে ফেলে, তখন তার জন্য কিছু কাজ নাজায়েয হয়ে যায়। এর মধ্যে একটি হলো কোনো প্রাণী হত্যা করা চাই সেটা যত ছোট হোক না কেনো। আল্লাহ তায়ালা বলেন- হে মুমিনগণ, ইহরামে থাকা অবস্থায় তোমরা শিকারকে হত্যা করো না। সূরা মায়িদা: ৯৫। এছাড়া সাধারণভাবে কা’বা শরীফের চারপাশে ৫০০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত সবধরনের প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ।
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- তোমাদের সৃষ্টিতে এবং জীবজন্তুর বিস্তারে নিদর্শন রয়েছে নিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্য। সূরা জাছিয়া: ৪। উক্ত আয়াতে মানুষ সৃষ্টি ও পশুপাখি সৃষ্টিকে সমানভাবে বিচার করা হয়েছে; উভয়টিকেই মুমিনদের জন্য নিদর্শন বলা হয়েছে। তাই বলা যায়, পশুপাখির সাথে সদয় আচরণ করা ও তাদের অধিকার সংরক্ষণ করা ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
Leave a Reply